Home Featured অনলাইনে চিতা বিক্রি

অনলাইনে চিতা বিক্রি

অপরাধীরা বারবার একই কাজ করছে

Mukto Chinta
0 comment 325 views

কাজী মেহেদী হাসান:  ফেসবুক কি অপরাধীদের ট্র্যাক  রেকর্ড রাখে না? তা না হলে একই ধরনের অপরাধ তারা কিভাবে বারবার করছে। গবেষকরা বলছেন, রিপোর্ট করার পর ওই  পোস্ট ডিলিট বা  কোনো  ক্ষেত্রে একাউন্ট বন্ধ করে দিচ্ছে  ফেসবুক। কিন্তু অপরাধীরা আবার নতুন একাউন্ট খুলে আবারও একই অপরাধ করছে। তাহলে কি  ফেসবুক তাদের ট্র্যাক  রেকর্ড নজরে রাখছে না?
দ্বিতীয় প্রশ্ন: সামাজিক মাধ্যম কি বন্যপ্রাণী  কেনাবেচার মাধ্যম হয়ে উঠেছে?  এই প্রশ্নটিও ওঠা স্বাভাবিক। কারণ প্রাণী ও জীববৈচিত্র রক্ষায় কাজ করে এমন কিছু সামাজিক সংগঠন সম্প্রতি “আভাজ ((AWAZ))” নামে একটি আন্দোলন গড়ে তুলেছে  যেখানে সামাজিক মাধ্যমের প্রধানদের কাছে এই  বেচাকেনা বন্ধ করার আবেদন জানানো হয়েছে।


‘আভাজ’ বা ‘আওয়াজ’ যাই বলুন না  কেন, সংগঠনটি আওয়াজ তুলেছে, যে কোন মূল্যে এই অবৈধ কেনাবেচা থামাতে হবে। তাদের শ্লোগান হচ্ছে  ঋধপবনড়ড়শ: টহভৎরবহফ ডরষফষরভব ঈৎরসরহধষং    বা “ফেসবুক: বন্যপ্রাণী অপরাধীদের বন্ধুত্ব ছাড়ুন”। এরই মধ্যে তারা প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের সাক্ষর সংগ্রহ করেছেন। বিশ্বের নানা প্রান্তের সেলিব্রেটিরা এই আবেদনটি শেয়ার ও স্পন্সর করছেন, আপনিও হয়তো আপনার সামাজিক মাধ্যমের পেইজে আবেদনটি দেখে থাকবেন।
“আভাজ” বলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে চিতা বা চিতা বাঘ। ‘আওয়াজ’  ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টিকটকসহ বিশ্বের বড় বড়  প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সিইও এবং আইন প্রণেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছে  “আপনার প্ল্যাটফর্মে বন্যপ্রাণী বাণিজ্য বন্ধ করতে আপনি যা পারেন, তাই করুন।“ তাদের দাবি সারা পৃথিবীতে মাত্র সাত হাজার চিতা থাকলেও এরই মধ্যে অনলাইন প্লাটফর্ম গুলোতে প্রায় দুই হাজার চিতা বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে। ফলে সামাজিক মাধ্যম বিপন্ন বন্যপ্রাণীর বিক্রির নিরাপদ   অনলাইন প্লাটফর্ম হয়ে উঠেছে।


তৃতীয় প্রশ্ন: আসলেই কি অনলাইনে বন্যপ্রাণী বেচাকেনা করা যায় ?  কিভাবে তারা বন্যপ্রানী ডেলিভারি দেয়? কারণ যে কোন পোস্টাল সার্ভিসের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী পরিবহন অবৈধ।
কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক প্যাট্রিসিয়া ট্রাইকোরাচে অবৈধ বন্যপ্রাণী ব্যবসা নিয়ে গবেষণা করেন । তিনি ইউরোপভিত্তিক পরিবেশবাদী নিউজ সাইট ইউরোনিউজ গ্রিনকে জানিয়েছেন, কিভাবে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের মাধ্যমে এসব কেনাবেচা হচ্ছে। তিনি সামাজিক মাধ্যম থেকে অসংখ্য ছবি সংগ্রহ করেছেন, যেখানে বিক্রি করা বন্যপ্রাণী মানুষের বাসা বাড়িতে রাখা হয়েছে। আবার কিছু প্রাণী রাখা হয়েছে বিক্রির জন্য। সামাজিক মিডিয়া, বিক্রয় সাইট এবং এমনকি ব্যক্তিগত মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে বন্যপ্রানী বা চিতা বিক্রির বিজ্ঞাপণ ছড়িয়ে পড়েছে। ট্রাইকোরাচে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, অবৈধ বন্যপ্রাণী বিক্রির সমস্যা ব্যাপক। গোপনে ব্যক্তিগত পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে এসব প্রানী ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে। গত বছরের এপ্রিলে তার একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে সেখানে দেখা গেছে ৫২৮ জন ব্যক্তি ২৩১৫টি চিতা বিক্রির বিজ্ঞাপণ দিয়েছে। তারা বলছেন ৮৮ ভাগ চিতা সামাজিক মাধ্যমে বিক্রি হয়ে থাকে।  সামাজিক প্লাটফর্ম এবং অনলাইন পোস্ট থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে অন্তত ২২৯৮টি চিতা বন থেকে শিকার করা হয়েছে এবং বিক্রির জন্য অন্য কোন জায়গায় রাখা হয়েছে।


ট্রাইকোরাচে জানান,  এখন চিতা বিক্রি সংক্রান্ত সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপণের বড় অংশ প্রচার হচ্ছে হচ্ছে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে। শতকরা ৭৫ ভাগেরও বেশি বিজ্ঞাপণ এই দুই মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। তাদের গবেষনায় দেখা গেছে বন্যপ্রানী বিক্রির ৯৯ ভাগ বিজ্ঞাপণের ভাষা ছিল আরবি। উপসাগরীয় দেশগুলোতে যেখানে পোষাপ্রাণী হিসেবে বন্যপ্রাণী বাড়িতে রাখা বেশ জনপ্রিয়। তবে তারা দেখেছেন গত তিনবছর ধরে বিজ্ঞাপণের দেয়ার হার ক্রমশ কমছে। এটি সম্ভবত উপসাগরীয় দেশগুলোতে বন্যপ্রাণীর মালিকানা ঘিরে ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রনের কারণে।
তবে গবেষণায় বলা হয়েছে, এখন যারা অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করছেন তারা “বিক্রয়” শব্দটি ব্যবহার করা বা প্রকাশ্যে মূল্য পোস্ট করা এড়িয়ে যাচ্ছেন। পরিবর্তে, পোস্টের প্রতিক্রিয়া ব্যক্তিগত, এনক্রিপ্ট করা মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগের জন্য আলাদা লিংক বা নম্বর দিয়ে দিচ্ছে যেখানে বিক্রেতারা এই লেনদেনগুলি সেটআপ করতে পারে।
ফেসবুকের মূল সংস্থা, মেটা, বলছে  বিপন্ন বন্যপ্রাণী বা তাদের অংশের ব্যবসা তাদের প্লাটফর্মে নিষিদ্ধ। বড়  প্রযুক্তি সংস্থাটি অনলাইন বন্য প্রাণী পাচার বন্ধ করার জোটের সদস্য এবং ডডঋ, ঞজঅঋঋওঈ এবং এডুকেশন ফর নেচার ভিয়েতনামের সাথে অংশীদারিত্ব রয়েছে।


এটি দাবি করে যে ২০১৬ সাল থেকে এমন বিষয়বস্তু সনাক্ত করতে ডডঋ এবং আন্তর্জাতিক তহবিল ফর অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ারে সাথে কাজ করছে। যারা অবৈধ বন্য প্রাণী বিক্রি করতে চায় তারা তাদের সনাক্তকরণের চেষ্টা করে এবং অনান্য সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে তথ্য শেয়ার করে।
তবে ট্রাইকোরাচে বলছেন, ফেসবুক (মেটা) তাদের মতো করে এসব বিজ্ঞাপণ বন্ধে কাজ করছেন।  বিজ্ঞাপণদাতারা শব্দ প্রয়োগ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতামূলক  পদক্ষেপ নিয়েছে, সেক্ষেত্রে এখনও ফেসবুক প্লাটফর্ম ব্যবহার করা হচ্ছে। তার অভিযোগ, বিজ্ঞাপনগুলো এখনও আছে এবং বিক্রেতারা এখন আর হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছে না। এর বিপরীতে তারা  ভিডিও বা ছবিগুলিতে কোনো ‘শব্দ’ ব্যবহার না করে নিজেরো আরও সতর্কতা অবলম্বন করছে। ফলে তদারকি ফাঁকি দেয়ার নতুন নতুন কৌশলের কারণে এদেরকে সনাক্ত করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধু ‘মেটা’ নয়, অন্যান্য  স্ন্যাপচ্যাট এবং টিকটকে পরিচিত ক্রেতাদের কাছে সরাসরি মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী কেনাবেচা আরও ব্যাপকতর হয়ে উঠছে।
ট্রাইকোরাচে বলেন, “আমরা জানি যে এই পোস্টগুলোর ব্যাপারে রিপোর্ট করলে পোস্টগুলো সরিয়ে দেয়া হবে। এছাড়া নীতিমালার শর্ত ভাঙ্গার দায়ে তাদের একাউন্ট বন্ধ করে দেয়া হতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ফেসবুক এসবের কি কোন প্রমান রাখে ?  মনে হয় রাখে না। রাখে না বলেই অবৈধ বন্যপ্রাণী বিক্রেতারা যখন আবার নতুন একাউন্ট খুলছে এবং নতুন করে পোস্ট দিচ্ছে তাদের খুঁজে পাওয়া আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছে।”

Jখ

ট্রাইকোরাচে বলেন যে বন্যপ্রাণীর ছবি বা ভিডিও পোস্ট করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী পশুপ্রেমীদের আরও সতর্ক হওয়া দরকার। কারণ সামাজিক মাধ্যমের পোস্টগুলো অনেক সময় বন্যপ্রাণী পালন করার বা আটকে রাখার ঝুঁকি তৈরি করে। এত অনেকেই পশু আটক করে রাখতে আগ্রহী হয়ে উঠে। তার মতে, বন্যপ্রানীর ছবি বা ভিডিও যখন সামাজিক মাধ্যমে অনেক বেশি লাইক ও প্রশংসনীয় মন্তব্য পায়-সেটা বন্যপ্রাণীর ক্রেতাকে উৎসাহিত করে।  তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, এই পোস্টগুলি লাইক করা অনেকেই বুঝতে পারেন না যে, মিলিয়ন ডলারের গাড়ির যাত্রীর আসনে বসে থাকা ধনী প্রভাবশালীদের অনেকেই এ ধরণের পোষা প্রাণীর মালিক হতে চান।
চিতা কনজারভেশন ফান্ডের তথ্য মতে, বন্যপ্রাণী আটকে রাখার এই প্রবনতা জঙ্গলে চিতার নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলেছে। পাচারের শিকার হওয়া চিতার চারটির মধ্যে মাত্র একটি বেঁচে থাকে। বনের বাইরে চিতার বেঁচে থাকার গড় আয়ু মাত্র দুই বছর। অর্থাৎ বেশিরভাগ চিতাই বনের বাইরে সঠিক পরিচর্যা ও পরিবেশের অভাবে দু’বছরের বেশি সময় বাঁচতে পারে না।
১৯৭৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক সীমান্তে বন্য চিতা বিক্রি কার্যকরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তখন বিশ্বজুড়ে বনাঞ্চলে ১৪ হাজার চিতার বসবাস ছিল এবং এখন  সাত হাজারে নেমে গেছে। আইন থাকলেও এভাবে ফাঁক গলিয়ে বিশ্বের  সবচেয়ে দ্রুতগতির স্তন্যপায়ী প্রাণীটি  বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে।


ট্রাইকোরাচে বিশ্বাস করেন সামাজিক মাধ্যমগুলো আরও বেশি দায়িত্বশীল  হলে চিতা বেচাকেনা কমিয়ে আনা সম্ভব। কারণ বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কাছে প্রাণীর বিক্রির জন্য আপলোড করা ছবি সনাক্তকরার সরঞ্জাম রয়েছে। তারা চাইলে অনেকভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে।
ইউরো নিউজগ্রীন বলছে, চিতা এখন তাদের জন্মের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতহারে মারা যাচ্ছে। যদি আটক প্রাণীগুলোকে বনাঞ্চলে ছেড়ে দেয়ার পাশাপাশি অনলাইনে বা প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে বিক্রি বন্ধ করা যায় তাহলে চিতার সংখ্যা স্থিতিশীল হতে পারে।
ফেসবুক, টুইটার, টিকটক, স্ন্যাপচাটের মতো জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমগুলোকে কত উপায়ে ব্যবহার করা হচ্ছে তার হিসাব করা কঠিন। তবে প্রত্যেক সামাজিক মাধ্যমের হাতে তাদের প্রতিষ্ঠানকে  নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা রাখা উচিত। প্রযুক্তির ব্যবহার, এলগরিদম বা মেটাডাটার মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যম অনেক ক্ষতিকর জিনিস সরিয়ে ফেলতে ও ট্র্যাক রাখতে পারে । সেটা করতে পারলে পরবর্তীতে কোন নীতিমালা ভঙ্গকারি নতুন করে অন্যায়ের সুযোগ সহজে পাবে না। আর অবশ্যই  ভবিষ্যতে বন্যপ্রাণীর ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করার আগে সবাইকে সতর্কতার পরিচয় দেয়া উচিত। আমাদের ছবি যেন কোন বন্যপ্রাণী শিকারিকে প্ররোচিত বা আগ্রহী করে না তুলে।কাজী মেহেদী হাসান: পিএইচডি শিক্ষার্থী, মাস কম্যুনিকেশন এন্ড মিডিয়া, সাউদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।

You may also like

Leave a Comment

Muktochinta

Multochinta is a famous news media from New York. 

Subscribe my Newsletter for new blog posts, tips & new photos. Let's stay updated!

All Right Reserved. 2022 emuktochinta.com